আমার লেখা প্রিয় কিছু কবিতা ও ছড়া

সার্থক জনম

 সুশান্ত কুমার রায়   


সার্থক জনম মাগো আমার

জন্মেছি এই দেশে,                                                              

হয়েছি বড়- তোমার কোলে মাগো

ধূলো-কাঁদামাটি মেখে

 

হাজারো মায়ার বাঁধনে

বেঁধে রেখেছো- তুমি যে মাগো,

শত জনম ধরে-

তোমার আঁচলে বাঁধা থাকি যেন- গো

 

পাল তুলে হাল ধরে

গায় মাঝি গান,

কী! অপরূপ শোভা তোমার

ভরে যায় প্রাণ

 

মাঠে-ঘাটে বাজে রাখালের বাঁশি

কৃষকের মুখে দেখি মধুর হাসি,

সাগরের ঢেউ আর নদীর কলতান

ফুলের হাসিতে চলে কোকিলের গান

 

শরতের নীলাকাশে ছুটে চলে

সাদা মেঘের ভেলা,

বক আর পানকৌড়ির দল

নীড়ে ফিরে যে- সন্ধ্যাবেলা

 

মাগো, ধন্য আমি- ধন্য মাগো

চেয়ে দেখি যতদূর,

এক জনমে মিটবে না আশা

এ যে সীমাহীন সমুদ্দূর

 

কী যে বলি ?  মাগো

কী করে ভুলি যে তোমায় !

মরণের পরে, তোমার চরণ তলে

দিও মাগো- ঠাঁই আমায়

জন্মভূমি

সুশান্ত কুমার রায়

 

রূপবতী সোনার দেশ আমার

কবিতা-গানে ভরপুর,

নীল আকাশ পাহাড়ী ঝর্ণা

সবুজ শ্যামল নীলিমা-প্রকৃতি অপরূপ

 

পদ্ম-শাপলা শামুক-ঝিনুক

নদ-নদী হাওর বিল,

কৃষ্ণচূড়া সোনালু হিজল তমাল

শঙ্খ-শালিক আর গাংচিল

 

জাম জামরুল কদবেল

আতা কাঁঠাল নারকেল,

নানা রংয়ের ফল-ফলাদির বাহারে

স্বাদে ভরে যায় মন আহা ! রে

 

তাল নারিকেল সুপারি গাছে

বাবুই পাখি বাসা বাঁধে,

ঘাসের ডগায় ফড়িং নাচে

ফুটিক জলে চাতক কাঁদে

 

রাখাল বন্ধু বাজায় বাঁশি

গুনগুনিয়ে ভ্রমর উড়ায়,

বটবৃক্ষের শীতল ছায়ায়

শ্রমিক মজুর প্রাণ জুড়ায়

 

এইতো সোনার দেশ আমার

রূপবৈচিত্র্যে ভরপুর,

মাতৃভূমি প্রিয় দেশ আমার

জন্মভূমি প্রিয় বাংলাদেশ

                    

 


ষড়ঋতু

সুশান্ত কুমার রায়



ষড়ঋতুর দেশ আমাদের দেশ,

রূপের যে তার নাইকো শেষ

 

গ্রীষ্ম আসে-

তাপদগ্ধ প্রকৃতি নিয়ে,

বর্ষা আসে-

বারি বর্ষণে

 

শরৎ আসে-

কাঁশ ফুলের নরম ছোঁয়ায়,

হেমন্ত আসে-

কৃষকের হাসি আর গানে

 

শীত আসে-

হৃদয়ে কাঁপুনি দিয়ে,

বসন্ত আসে-

কোকিলের সুমধুর ডাকে

 

ছয়টি ঋতু বিচিত্ররূপে আসে

আমাদেরই মাঝে এইখানে


গাঁয়ের কথা

 সুশান্ত কুমার রায়     

                    

শহরে এসে গাঁয়ের কথা

পড়ছে মনে আজ,

ছিলাম কত আমরা আপন

ভুলে সকল লাজ।

 

পাখির গানে নদীর স্রোতে

কলকলানি সুর,

মধুর সুরে গায় যে মাঝি

যাইতো বহুদূর।

 

শীতল ছায়ায় শ্রমিক মজুর

জুড়ায় তাঁদের প্রাণ,

আসতো ভেসে পাশের বাড়ির

ইলিশ মাছের ঘ্রাণ।

 

বিলের পাড়ে বকের সারি

নদীর ধারে কাঁশ,

হইতো মনে কত আপন

সেথায় মোদের বাস।

 

মাকে আমার পড়ছে মনে

পড়ছে বারে বার,

গাঁয়েই কত স্বপ্ন সুখ

হইতো জীবন পার।

 

 


বসন্ত অবগাহনে

সুশান্ত কুমার রায়

 

বসন্তদূত কোকিলের কুহু-কৃহু তান

ঋতুরাজ বসন্তেরই আগমনী গান,

রক্তিম আভায় কৃষ্ণচূড়া-পলাশ-শিমুল,

ফুটে আছে আরো নানান রঙের ফুল।

গোলাপ-গাঁদা-জুঁই- বেলী,

মহুয়া-পারুল-মল্লিকা- মালতি।

 

গাছে গাছে নবপত্র-পল্লব কুঁড়ি

ফুলে ফুলে মৌমাছিদের গুঞ্জরন,

লাল-হলুদ-নীল আর সবুজে

ভরে যায় সবার মন।

বাতাসে ভাসে শত ফুলের ঘ্রাণ,

সুমধুর কন্ঠে চলে পাখিদের গান।

 

মৌমাছি ব্যাকুল হয় আম্রমুকুলের গন্ধে

প্রজাপতি রঙিন ডানা মেলে মনের আনন্দে,

‘বউ কথা কও’  ডাক দেয় বসন্ত বাউরি

করুণ বিষাদের সুর একুশে ফেব্রুয়ারি।

ভ্রমরের গুনগুন ফুলে ফুলে মধু আহরণে

প্রকৃতি মাতোয়ারা আজ বসন্ত অবগাহনে।


কালের খেয়া

সুশান্ত কুমার রায়



দিনের পর দিন

যুগের পর যুগ,

কাল থেকে মহাকাল

সীমানা পেরিয়ে অসীময়তায় অবগাহন

 

অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এর

আবর্তে চলছে কালের খেয়ায় তরী,

চলমান জীবনে বহমান বর্তমান, আর-

ভবিষ্যৎ এর আশা আকাঙ্খা আর

স্বপ্ন নিয়েই তো আমাদের বেঁচে থাকা

 

কালের খেয়ায় চলছি নিরবধি

কোথায় গিয়ে ভিরবে যে তরী খানি-

বর্তমান না ভবিষ্যৎ, কে জানে?

তবুও এ চলা নিরন্তর....

 


নগ্নতায় মগ্ন

সুশান্ত কুমার রায়

 

উলঙ্গ ও নশ্বর এই পৃথিবীতে

বৃত্তীয় সীমানার মধ্যে আজ আর কেউ নেই,

ভূষণ ও আচ্ছাদনে বিশ্বাসী নই

শরীরী কিংবা অশরীরী নগ্নতায় মগ্ন ও মত্ত আজ

 

সৌন্দর্য ও নন্দনতত্ত্বের উপমা অলঙ্করণ-

কতখানি চিন্তার ভূগোলে আবদ্ধ, তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ ?

লাগামহীন ক্ষমতার দাপট আর লোভ-লালসার মোহে

আমরা আজ আচ্ছন্ন ও অন্ধ হয়ে আছি




বিস্ময় জাগে মনে

 সুশান্ত কুমার রায়


ধানের ক্ষেতের ধারে, সবুজ মাঠের পড়ে

আমি দাড়িয়ে ভাবি, কি বিস্ময় বিধাতার!

নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলেছি আমরা সবাই

তবুও কেন ? এ ধরা ক্ষত-বিক্ষত আমরা আজ বড় অসহায়

 

নিজ ভাগ্য গড়িতে তিনি, অপার ধরিত্রী দিয়েছেন ছেড়ে

কে কার ভাগ্য লয় ? আপন মহিমা রচিতে !

এ জীবন হেলাফেলা নয়, বিধাতাকে করো ভয়

সময় থাকিতে করো খেলা, নয়তো ডুবিলে বেলা, সাঙ্গ হবে খেলা

 

আরও বিস্ময় জাগে মনে, নানা প্রশ্ন জ্ঞানে

কর্মের মাঝে কীর্তি, ধ্যান বিরাজে  জ্ঞাণী

শত শত যুগ কী কারণে স্মরিবে তোমায় ?

অসীমের মাঝে সসীম তিনি, জানেন- একজনই আমার অর্ন্তযামী

 


বটবৃক্ষ

সুশান্ত কুমার রায়


শৈশব-কৈশোর তারুণ্য, অতঃপর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে,

তিলে তিলে গড়া সংসারে,

শিউলী বকুল কিংবা কদম্ব কেতকীর নয়-

মিশে আছে ঘামেরই উৎকট ঘ্রাণ-সোদা মাটির গন্ধ

 

মায়ের শাড়ীর আঁচলে বাঁধা ছিলো মায়া মমতার

দীপ্ত জ্যোতির-অমীয় সুন্দরের বাণী

আমাদের রক্তের শেকড়ে আছে

বার্ধক্যে মুহ্যমান- ক্ষীণ হয়ে আসা দৃষ্টির

নিথর দেহের বটবৃক্ষ,

ভালোবাসার বন্ধনে, সেই বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায়

আমরা আজ যারা- প্রাণ জুড়িয়ে চিরসবুজ- গর্বিত উত্তরসূরী

 

তাঁদেরই বিষবাষ্প আর অবহেলায়

কঙ্কালসার ন্যূয়েপড়া নিথর দেহে- প্রিয় সন্তানের অপ্রিয় বাক্য-

ঢেউ তোলে উত্তাল তরঙ্গমালার-

খরাদগ্ধ বিরান মরুভূমি আর বজ্রপাতের দাহ নিঃশ্বাস

 

নিয়তির বাস্তবতায় সত্যের উঠোনে আজ কাঁদে বেহুলা,

বটবৃক্ষের ঈষানকোণে অশ্রুসজল দিশেহারা মন

চেনা মানুষের ভীড়ে আজ অচেনা হৃদয়,

আত্মসম্মান মান মর্যাদা- সুনাম খ্যাতি যশ

স্বপ্নের মরা গাঙে ভাসে বৃদ্ধাশ্রম, ধূ-ধূ প্রান্তর-বালুচর

 

এসো আমরাও সত্যপথ ধরি, তৃপ্ত মধুর জীবন গড়ি,

নয়তো ফলবে না আবাদ- ভরবে না আর মাঠ

ফুটবে না হাসি, উঠবে না সূর্য দিগন্তে- শান্তির প্রত্যাশায়

 


বন্দী

সুশান্ত কুমার রায়

 

বন্দী আমি-

        শেকলে বাধা আমার হাত-পা,

        শৈশবের দুরন্তপনা আমাকে মুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়

 

বন্দী আমি-

        অফিসে, বাড়িতে, সন্তান-সন্ততি ও সহধর্মিনীর কাছে,

        তারুণ্যে ভরা কৈশোর আমাকে মুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়

 

বন্দী আমি-

        শেকলে বাধা আমার মন ও মনন,

        পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কার কাছে যাবো আমি?

 

বন্দী আমি-

       মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা আমার খর্ব-

       প্রতিবন্ধকতা-বাধাবিপত্তি সংকীর্ণতার দেয়ালের গন্ডি পেরিয়ে-

       মুক্তির উল্লাসে আমি মানবতার গান গাইতে চাই

 

কিন্তু বন্দী আমি-

        নিজেই নিজের বিবেকের কাছে,

        বিবেক বড়ই পীড়াদায়ক, ব্যাথিত করে তুলেছে আমায়-

        আর পেরে উঠতে পারিনা আমি-দুঃসহ জ্বালা যন্ত্রণায় উম্মাদ আমি

 

বন্দী আমি-

      বন্দী আমি শত জনম ধরে,

      যতসব নিয়ম-নীতি আর শেকলের বেড়ে-

      বন্দী আমি শত জনম- হাজার জনম ধরে

 

 

 

 


শরতের পড়ন্ত বিকেলে

 সুশান্ত কুমার রায়


শ্বেত শ্রভ্র কাঁশফুল-

আর স্বচ্ছ নীলাকাশে,

সাদা মেঘের ভেলা

সতী নদী মরে এখন সেখানে চাষবাস

 

ঝাঁকে ঝাঁকে বলাকা-

আর পানকৌড়ির দল উড়ে যায়,

নীল আকাশের দূর সীমানা পেরিয়ে

অচেনা গন্তব্যের দিকে

 

এক সময় দৃষ্টির অন্তরালে চলে যায়

শরতের পড়ন্ত বিকেলের

সোনালী রোদে,

মনে পড়ে যায় অতীত স্মৃতি

হৃদয় বড়ই ব্যাকুল হয়ে ওঠে

অশ্রু ঝরে দুয়নে বোবা কান্নায়...


 কবিত্ব

সুশান্ত কুমার রায়


 

কবিতা লিখলেই কবি নয়

কবি কবি ভাব নিলেই কী কবি হয় ?

কবিতার রাজ্য বিশাল সমুদ্র হয়

যে সমুদ্রের জল ফুরাবার নয়

 

কবিতা লিখলেই কবি নয়

আবার কবিতা না লিখেও কবি হয়

যে কবি নিঃশব্দে কথা বলে

প্রকৃতি-প্রেম ও মানুষের...


নীতি-নৈতিকতা

সুশান্ত কুমার রায়


যেখানে-

কাকের চেয়েও কবির সংখ্যা বেশি

জ্ঞানের চেয়েও জ্ঞানীর সংখ্যা বেশি

বুদ্ধিমত্তার চেয়ে বুদ্ধিজীবির সংখ্যা বেশি

সংগত কারণেই সেখানে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নও প্রকট হয়ে দাড়ায়???


আবার যেখানে-

কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা নিতান্তই কম

জ্ঞানীর মধ্যে জ্ঞানের পরিধি সুগভীর

বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিমত্তায় সর্বাগ্রে সমুজ্জ্বল

সংগত কারণেই সেখানে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে

মানবিক মুল্যবোধ অনেকখানি জাগ্রত হয় নিঃসন্দেহে

 



 


অধিকার 

সুশান্ত কুমার রায়

 

আমি জন্মেছি এই বাংলায়, বাংলা আমার মায়ের ভাষা

রফিক, বরকত, শফিক, সালাম আমার ভাই

কেন বার বার নয়নের জলে ভেজে আমার দুঃখিনী মায়ের মন

আমি তো রক্তে ভিজিয়েই পেয়েছি আমার প্রিয় সেই বর্ণমালা

 

হে বিধাতা, কী দোষ করেছি আমি-

আমার কি অধিকার নেই এদেশ- আমার মাটিতে ?

আমি তো জানি নিজ ভূমে বেঁচে থাকার অধিকার

আমার জন্মগত অধিকার।


আমি জন্মেছি এই বাংলায়, আমার পূর্বপুরুষের চিহ্ন

আজও শতাব্দীর পর শতাব্দী কালের স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে

আমি তো এসেছি সিন্ধু সভ্যতা থেকে-


মহাকালের স্বাক্ষী মহাস্থানগড়ের বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর থেকে

পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার, তিতুমীর, হাজী শরীয়ত উল্লাহ

সোনা মসজিদ আমার পরিচয়।


আমি বাংলায় গান গাই, বাংলা আমার ভাষা

সাঁওতাল, মারমা, মগ, মুরং, টিপরা আর

সবুজ-শ্যামল নীলিমা ও বৈচিত্র্যে ভরা আমার জন্মভূমি।

মাতৃভূমি প্রিয় সোনার দেশ আমার

জন্মভূমি প্রিয় বাংলাদেশই আমার অধিকার

 


আমার দেশের ছবি আঁকি

 সুশান্ত কুমার রায়


আমার দেশের ছবি আঁকি

রঙ তুলিতে ফুল পাখি,

নদী-নালা, খাল-বিল

ময়না টিয়া গাঙচিল।

 

পাল তুলে নৌকা চলে

বর্ষাকালে নদীর জলে,

অথৈ জলে থৈ থৈ

মাঝিমাল্লার হৈ চৈ।

 

শাপলা শালুক পদ্ম আঁকি

নদীর ধারে কাশবন,

নীল আকাশে মেঘের ভেলা

ভরে যায় সবার মন।

 

চোখে ভাসে অনেক ছবি

কোনটি ছেড়ে কোনটি আঁকি?

রঙ তুলিতে সোনার দেশ

নানা রঙে আহা! বেশ।

 

জাম- জামরুল-কদবেল

আতা-কাঁঠাল-নারকেল,

নানান ফলের বাহারে

রঙ তুলিতে আহা! রে।

 

গুনগুনিয়ে ভ্রমর আসে

ফড়িং নাচে ঘাসের কাছে,

গ্রামবাংলার দৃশ্যগুলি

তুলির টানে রাঙিয়ে তুলি।

 

আরও আঁকি ছোট্ট পাখি

হরেক রকম অনেক মাছ,

রুই- কাতলা, চিতল-বোয়াল

খলসে-পুটি-কালবাউস।

 

 

 


জীবনের গান

 সুশান্ত কুমার রায়


গাও-গাও জীবনের গান

ধরো হাল, তুলো পাল-

জীবন বীণায় বাজাও তুমি

তোলো সুর-লহরী তান

 

এসো হাতে হাত রেথে

চোখে চোখ মেলে,

হৃদয়ে হৃদয় ছুইঁয়ে-

গাই বিজয়ের গান

 

এ জীবন তরী

দিতে হবে পাড়ি,

গাইবোই গাইবো আমরা-

বিজয় কেতনের গান

 

আর নয় হেলাফেলা

ডুবে যাবে যে বেলা?

হাতে-হাত রেখে ধরো গান

তোলো সুর লহরী তান।।